গোরা
তিন বেলা স্নান করায়, তার উপরে আবার এমনি হঠযোগ লাগিয়েছে যে চোখের তারা-ভুরু নিশ্বাসপ্রশ্বাস নাড়িটাড়ি সমস্ত একেবারে উলটো-পালটা হবার জো হয়েছে। বাবা বেঁচে থাকতে থাকতে শশীর বিয়েটা হয়ে গেলেই সুবিধা হয়— ওঁর পেন্‌শনের জমা টাকাটা ওঙ্কারানন্দস্বামীর হাতে পড়বার পূর্বেই কাজটা সারতে পারলে আমাকে বেশি ভাবতে হয় না। বাবার কাছে কথাটা কাল পেড়েওছিলুম, দেখলুম বড়ো সহজ ব্যাপার নয়। ভেবেছি ঐ সন্ন্যাসী বেটাকে কিছুদিন খুব কষে গাঁজা খাইয়ে বশ করে নিয়ে, ওরই দ্বারা কাজ উদ্ধার করতে হবে। যারা গৃহস্থ, যাদের টাকার দরকার সব চেয়ে বেশি, বাবার টাকা তাদের ভোগে আসবে না এটা তুমি নিশ্চয় জেনো। আমার মুশকিল হয়েছে এই যে, অন্যের বাবা কষে টাকা তলব করে আর নিজের বাবা টাকা দেবার কথা শুনলেই প্রাণায়াম করতে বসে যায়। আমি এখন ঐ এগারো বছরের মেয়েটাকে গলায় বেঁধে কি জলে ডুব দিয়ে মরব?”

৬২

হরিমোহিনী জিজ্ঞাসা করিলেন, “রাধারানী, কাল রাত্রে তুমি কিছু খেলে না কেন?”

সুচরিতা বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেন, খেয়েছি বৈকি।”

হরিমোহিনী তাহার ঢাকা খাবার দেখাইয়া কহিলেন, “কোথায় খেয়েছ? ঐ-যে পড়ে রয়েছে।”

তখন সুচরিতা বুঝিল, কাল খাবার কথা তাহার মনেই ছিল না।

হরিমোহিনী রুক্ষ স্বরে কহিলেন, “এ-সব তো ভালো কথা নয়। আমি তোমাদের পরেশবাবুকে যতদূর জানি, তিনি যে এতদূর সব বাড়াবাড়ি ভালোবাসেন তা তো আমার মনে হয় না— তাঁকে দেখলে মানুষের মন শান্ত হয়। তোমার আজকালকার ভাবগতিক তিনি যদি সব জানতে পারেন তা হলে কী বলবেন বলো দেখি।”

হরিমোহিনীর কথার লক্ষ্যটা কী তাহা সুচরিতার বুঝতে বাকি রহিল না। প্রথমটা মুহূর্তকালের জন্য তাহার মনের মধ্যে সংকোচ আসিয়াছিল। গোরার সহিত তাহার সম্বন্ধকে নিতান্ত সাধারণ স্ত্রীপুরুষের সম্বন্ধের সহিত সমান করিয়া এমনতরো একটা অপবাদের কটাক্ষ যে তাহাদের উপরে পড়িতে পারে এ কথা সে কখনো চিন্তাই করে নাই। সেইজন্য হরিমোহিনীর বক্রোক্তিতে সে কুণ্ঠিত হইয়া পড়িল। কিন্তু পরক্ষণেই হাতের কাজ ফেলিয়া সে খাড়া হইয়া বসিল এবং হরিমোহিনীর মুখের দিকে চোখ তুলিয়া চাহিল।

গোরার কথা লইয়া সে মনের মধ্যে কাহারো কাছে কোনো লজ্জা রাখিবে না ইহা মুহূর্তের মধ্যে সে স্থির করিল, এবং কহিল, “মাসি, তুমি তো জান, কাল গৌরমোহনবাবু এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপের বিষয়টি আমার মনকে খুব অধিকার করে বসেছিল, সেইজন্যে আমি খাবারের কথা ভুলেই গিয়েছিলুম। তুমি থাকলে কাল অনেক কথা শুনতে পেতে।

হরিমোহিনী যেমন কথা শুনিতে চান গোরার কথা ঠিক তেমনটি নহে। ভক্তির কথা শুনিতেই তাঁহার আকাঙ্ক্ষা; গোরার মুখে ভক্তির কথা তেমন সরল ও সরস হইয়া বাজিয়া ওঠে না। গোরার সম্মুখে বরাবর যেন একজন প্রতিপক্ষ আছে; তাহার বিরুদ্ধে গোরা কেবলই লড়াই করিতেছে। যাহারা মানে না তাহাদিগকে সে মানাইতে চায়, কিন্তু যে মানে তাহাকে সে কী বলিবে। যাহা লইয়া গোরার উত্তেজনা হরিমোহিনী তাহাতে সম্পূর্ণ উদাসীন। ব্রাহ্মসমাজের লোক যদি হিন্দুসমাজের সহিত না মিলিয়া নিজের মত লইয়া থাকে তাহাতে তাঁহার আন্তরিক ক্ষোভ কিছুই নাই, তাঁহার নিজের প্রিয়জনগুলির সহিত তাঁহার বিচ্ছেদর কোনো কারণ না ঘটিলেই তিনি নিশ্চিন্ত থাকেন। এইজন্য গোরার সঙ্গে আলাপ করিয়া তাঁহার হৃদয় লেশমাত্র রস পায় নাই। ইহার পরে হরিমোহিনী যখনই অনুভব করিলেন গোরাই সুচরিতার মনকে অধিকার করিয়াছে তখনই গোরার কথাবার্তা তাঁহার কাছে আরো বেশি অরুচিকর