গোরা

বিনয় চলিয়া গেল, মহিম ধীরে ধীরে ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিলেন। পান চিবাইতে চিবাইতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “সুবিধা হল না বুঝি? হবেও না। কতদিন থেকে বলে আসছি, সাবধান হও, বিগড়াবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে— কথাটা কানেই আনলে না। সেই সময়ে জোরজার করে কোনোমতে শশিমুখীর সঙ্গে ওর বিয়েটা দিয়ে দিতে পারলে কোনো কথাই থাকত না। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! বলি বা কাকে! নিজে যেটি বুঝবে না সে তো মাথা খুঁড়েও বুঝানো যাবে না। এখন বিনয়ের মতো ছেলে তোমার দল ভেঙে গেল এ কি কম আপসোসের কথা!”

গোরা কোনো উত্তর করিল না। মহিম কহিলেন, “তা হলে বিনয়কে ফেরাতে পারলে না? তা যাক, কিন্তু শশিমুখীর সঙ্গে ওর বিবাহের কথাটা নিয়ে কিছু বেশি গোলমাল হয়ে গেছে। এখন শশীর বিয়ে দিতে আর দেরি করলে চলবে না— জানোই তো আমাদের সমাজের গতিক, যদি একটা মানুষকে কায়দায় পেলে তবে তাকে নাকের জলে চোখের জলে করে ছাড়ে। তাই একটি পাত্র— না, তোমার ভয় নেই, তোমাকে ঘটকালি করতে হবে না; সে আমি নিজেই ঠিকঠাক করে নিয়েছি।

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “পাত্রটি কে?”

মহিম কহিলেন, “তোমাদের অবিনাশ।”

গোরা কহিল, “সে রাজি হয়েছে?”

মহিম কহিলেন, “রাজি হবে না! এ কি তোমার বিনয় পেয়েছ? না, যাই বলো, দেখা গেল তোমার দলের মধ্যে ঐ অবিনাশ ছেলেটি তোমার ভক্ত বটে। তোমার পরিবারের সঙ্গে তার যোগ হবে এ কথা শুনে সে তো আহ্লাদে নেচে উঠল। বললে, এ আমার ভাগ্য, এ আমার গৌরব। টাকাকড়ির কথা জিজ্ঞাসা করলুম, সে অমনি কানে হাত দিয়ে বললে, মাপ করবেন, ও-সব কথা আমাকে কিছুই বলবেন না। আমি বললুম, আচ্ছা, সে-সব কথা তোমার বাবার সঙ্গে হবে। তার বাপের কাছেও গিয়েছিলুম। ছেলের সঙ্গে বাপের অনেক তফাত দেখা গেল। টাকার কথায় বাপ মোটেই কানে হাত দিলে না, বরঞ্চ এমনি আরম্ভ করলে যে আমারই কানে হাত ওঠবার জো হল। ছেলেটিও দেখলুম এ-সকল বিষয়ে অত্যন্ত পিতৃভক্ত, একেবারে পিতা হি পরমং তপঃ— তাকে মধ্যস্থ রেখে কোনো ফল হবে না। এবারে কোম্পানির কাগজটা না ভাঙিয়ে কাজ সারা হল না। তা যাই হোক, তুমিও অবিনাশকে দুই-এক কথা বলে দিয়ো। তোমার মুখ থেকে উৎসাহ পেলে— ”

গোরা কহিল, “টাকার অঙ্ক তাতে কিছু কমবে না।”

‍ মহিম কহিলেন, “তা জানি, পিতৃভক্তিটা যখন কাজে লাগবার মতো হয় তখন সামলানো শক্ত।”

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কথাটা পাকা হয়ে গেছে?”

মহিম কহিলেন, “হাঁ।”

গোরা। দিনক্ষণ একেবারে স্থির?

মহিম। স্থির বৈকি, মাঘের পূর্ণিমাতিথিতে। সে আর বেশি দেরি নেই। বাপ বলেছেন, হীরে-মানিকে কাজ নেই, কিন্তু খুব ভারী সোনার গয়না চাই। এখন কী করলে সোনার দর না বাড়িয়ে সোনার ভার বাড়াতে পারি স্যাক্‌রার সঙ্গে কিছু দিন তারই পরামর্শ করতে হবে।

গোরা কহিল, “কিন্তু এত বেশি তাড়াতাড়ি করবার কী দরকার আছে? অবিনাশ যে অল্পদিনের মধ্যে ব্রাহ্মসমাজে ঢুকবে এমন আশঙ্কা নেই।”

মহিম কহিলেন, “তা নেই বটে, কিন্তু বাবার শরীর ইদানীং বড়ো খারাপ হয়ে উঠেছে সেটা তোমরা লক্ষ্য করে দেখছ না। ডাক্তারেরা যতই আপত্তি করছে ওঁর নিয়মের মাত্রা আরো ততই বাড়িয়ে তুলছেন। আজকাল যে সন্ন্যাসী ওঁর সঙ্গে জুটেছে সে ওঁকে