গোরা
আমার উপরে তুমি নির্ভর করো।”

সুচরিতা কোনো কথা কহিল না, কিন্তু নির্ভর করিতে তাহার যে কিছুই বাকি নাই এই কথাটি নিঃশব্দে ব্যক্ত হইল। গোরাও চুপ করিয়া রহিল, ঘরে অনেকক্ষণ কোনো শব্দই রহিল না। বাহিরে গলিতে পুরানো-বাসন-ওয়ালা পিতলের পাত্রে ঝন্‌ ঝন্‌ শব্দ করিয়া দ্বারের সম্মুখ দিয়া হাঁকিতে হাঁকিতে চলিয়া গেল।

হরিমোহিনী তাঁহার পূজাহ্নিক শেষ করিয়া পাকশালায় যাইতেছিলেন। সুচরিতার নিঃশব্দ ঘরে যে কোনো লোক আছে তাহা তাঁহার মনেও হয় নাই; কিন্তু ঘরের দিকে হঠাৎ চাহিয়া হরিমোহিনী যখন দেখিলেন সুচরিতা ও গোরা চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতেছে, উভয়ে কোনোপ্রকার শিষ্টালাপমাত্রও করিতেছে না, তখন এক মুহূর্তে তাঁহার ক্রোধের শিখা ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত যেন বিদ্যুদ্‌‍বেগে জ্বলিয়া উঠিল। আত্মসংবরণ করিয়া তিনি দ্বারে দাঁড়াইয়া ডাকিলেন, “রাধারানী!”

সুচরিতা উঠিয়া তাঁহার কাছে আসিলে তিনি মৃদুস্বরে কহিলেন, “আজ একাদশী, আমার শরীর ভালো নেই, যাও তুমি রান্নাঘরে গিয়ে উনানটা ধরাও গে— আমি ততক্ষণ গৌরবাবুর কাছে একটু বসি।”

সুচরিতা মাসির ভাব দেখিয়া উদ্‌‍বিগ্ন হইয়া রান্নাঘরে চলিয়া গেল। হরিমোহিনী ঘরে প্রবেশ করিতে গোরা তাঁহাকে প্রণাম করিল। তিনি কোনো কথা না কহিয়া চৌকিতে বসিলেন। কিছুক্ষণ ঠোঁট চাপিয়া চুপ করিয়া থাকিয়া কহিলেন, “তুমি তো, বাবা, ব্রাহ্ম নও?”

গোরা কহিল, “না।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “আমাদের হিন্দুসমাজকে তুমি তো মান?”

গোরা কহিল, “মানি বৈকি।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “তবে তোমার এ কী রকম ব্যবহার?”

গোরা হরিমোহিনীর অভিযোগ কিছুই বুঝিতে না পারিয়া চুপ করিয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

হরিমোহিনী কহিলেন, “রাধারানীর বয়স হয়েছে, তোমরা তো ওর আত্মীয় নও— ওর সঙ্গে তোমাদের এত কী কথা! ও মেয়েমানুষ, ঘরের কাজকর্ম করবে, ওরই বা এ-সব কথায় থাকবার দরকার কী? ওতে যে ওর মন অন্য দিকে নিয়ে যায়। তুমি তো জ্ঞানী লোক, দেশসুদ্ধ সকলেই তোমার প্রশংসা করে, কিন্তু এ-সব আমাদের দেশে কবেই বা ছিল, আর কোন্‌ শাস্ত্রেই বা লেখে!”

গোরা হঠাৎ একটা মস্ত ধাক্কা পাইল। সুচরিতার সম্বন্ধে এমন কথা যে কোনো পক্ষ হইতে উঠিতে পারে তাহা সে চিন্তাও করে নাই। সে একটু চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “ইনি ব্রাহ্মসমাজে আছেন, বরাবর এঁকে এইরকম সকলের সঙ্গে মিশতে দেখেছি, সেইজন্যে আমার কিছু মনে হয় নি।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “আচ্ছা, ঐ নাহয় ব্রাহ্মসমাজে আছে, কিন্তু তুমি তো এ-সব কখনো ভালো বলো না। তোমার কথা শুনে আজকালকার কত লোকের চৈতন্য হচ্ছে, আর তোমার ব্যবহার এরকম হলে লোকে তোমাকে মানবে কেন? এই-যে কাল রাত্রি পর্যন্ত ওর সঙ্গে তুমি কথা কয়ে গেলে, তাতেও তোমার কথা শেষ হল না— আবার আজ সকালেই এসেছ! সকাল থেকে ও আজ না গেল ভাঁড়ারে, না গেল রান্নাঘরে, আজ একাদশীর দিনে আমাকে যে একটু সাহায্য করবে তাও ওর মনে হল না— এ ওর কী রকম শিক্ষা হচ্ছে! তোমাদের নিজের ঘরেও তো মেয়ে আছে, তাদের নিয়ে কি সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ করে তুমি এইরকম শিক্ষা দিচ্ছ— না, আর-কেউ দিলে তুমি ভালো বোধ কর?”

গোরার তরফে এ-সব কথার কোনো উত্তর ছিল না। সে কেবল কহিল, “ইনি এইরকম শিক্ষাতেই মানুষ হয়েছেন বলে আমি এঁর সম্বন্ধে কিছু বিবেচনা করি নি।”