গোরা

হরিমোহিনী কহিলেন, “ও যে শিক্ষাই পেয়ে থাক্‌ যতদিন আমার কাছে আছে আর আমি বেঁচে আছি এ-সব চলবে না। ওকে আমি অনেকটা ফিরিয়ে এনেছি। ও যখন পরেশবাবুর বাড়িতে ছিল তখনই তো আমার সঙ্গে মিশে ও হিঁদু হয়ে গেছে রব উঠেছিল। তার পরে এ বাড়িতে এসে তোমাদের বিনয়ের সঙ্গে কী জানি কী সব কথাবার্তা হতে লাগল, আবার সব উলটে গেল। তিনি তো আজ ব্রাহ্মঘরে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। যাক্‌! অনেক কষ্টে বিনয়কে তো বিদায় করেছি। তার পরে হারানবাবু বলে একটি লোক আসত; সে এলেই আমি রাধারানীকে নিয়ে আমার উপরের ঘরে বসতুম, সে আর আমল পেল না। এমনি করে অনেক দুঃখে ওর আজকাল আবার যেন একটু মতি ফিরেছে বলে বোধ হচ্ছে। এ বাড়িতে এসে ও আবার সকলের ছোঁওয়া খেতে আরম্ভ করেছিল, কাল দেখলুম সেটা বন্ধ করেছে। কাল রান্নাঘর থেকে নিজের ভাত নিজেই নিয়ে গেল, বেহারাকে জল আনতে বারণ করে দিলে। এখন, বাপু, তোমার কাছে জোড়-হাতে আমার এই মিনতি, তোমরা ওকে আর মাটি কোরো না। সংসারে আমার যে-কেউ ছিল সব মরে ঝরে কেবল ঐ একটিতে এসে ঠেকেছে, ওরও ঠিক আপন বলতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ওকে তোমরা ছেড়ে দাও। ওদের ঘরে আরো তো ঢের বড়ো বড়ো মেয়ে আছে— ঐ লাবণ্য আছে, লীলা আছে, তারাও বুদ্ধিমতী, পড়াশুনা করেছে; যদি তোমার কিছু বলবার থাকে ওদের কাছে গিয়ে বলো গে, কেউ তোমাকে মানা করবে না।”

গোরা একেবারে স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিল। হরিমোহিনী কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া পুনরায় কহিলেন, “ভেবে দেখো, ওকে তো বিয়েথাওয়া করতে হবে, বয়স তো যথেষ্ট হয়েছে। তুমি কি বল ও চিরদিন এইরকম আইবুড়ো হয়েই থাকবে? গৃহধর্ম করাটা তো মেয়ে মানুষের দরকার।”

সাধারণভাবে এ সম্বন্ধে গোরার কোনো সংশয় ছিল না— তাহারও এই মত বটে। কিন্তু সুচরিতা সম্বন্ধে নিজের মতকে সে মনে মনেও কখনো প্রয়োগ করিয়া দেখে নাই। সুচরিতা গৃহিণী হইয়া কোনো-এক গৃহস্থ-ঘরের অন্তঃপুরে ঘরকন্নায় নিযুক্ত আছে এ কল্পনা তাহার মনেও ওঠে না। যেন সুচরিতা আজও যেমন আছে বরাবর ঠিক এমনিই থাকিবে।

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “আপনার বোনঝির বিবাহের কথা কিছু ভেবেছেন নাকি?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “ভাবতে হয় বৈকি, আমি না হলে আর ভাববে কে?”

গোরা প্রশ্ন করিল, “হিন্দুসমাজে কি ওঁর বিবাহ হতে পারবে?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “সে চেষ্টা তো করতে হবে। ও যদি আর গোল না করে, বেশ ঠিকমত চলে, তা হলে ওকে বেশ চালিয়ে দিতে পারব। সে আমি মনে মনে সব ঠিক করে রেখেছি, এতদিন ওর যেরকম গতিক ছিল সাহস করে কিছু করে উঠতে পারি নি। এখন আবার দুদিন থেকে দেখছি ওর মনটা নরম হয়ে আসছে, তাই ভরসা হচ্ছে।”

গোরা ভাবিল, এ সম্বন্ধে আর বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করা উচিত নয়, কিন্তু কিছুতেই থাকিতে পারিল না; প্রশ্ন করিল, “পাত্র কি কাউকে মনে মনে ঠিক করেছেন?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “তা করেছি। পাত্রটি বেশ ভালোই— কৈলাস, আমার ছোটো দেবর। কিছুদিন হল তার বউটি মারা গেছে, মনের মতো বড়ো মেয়ে পায় নি বলেই এতদিন বসে আছে, নইলে সে ছেলে কি পড়তে পায়? রাধারানীর সঙ্গে ঠিক মানাবে।”

মনের মধ্যে গোরার যতই ছুঁচ ফুটিতে লাগিল ততই সে কৈলাসের সম্বন্ধে প্রশ্ন করিতে লাগিল।

হরিমোহিনীর দেবরদের মধ্যে কৈলাসই নিজের বিশেষ যত্নে কিছুদূর লেখাপড়া করিয়াছিল— কতদূর, তাহা হরিমোহিনী বলিতে পারেন না। পরিবারের মধ্যে তাহারই বিদ্বান্‌ বলিয়া খ্যাতি আছে। গ্রামের পোস্ট্‌মাস্টারের বিরুদ্ধে সদরে দরখাস্ত করিবার সময় কৈলাসই এমন আশ্চর্য ইংরাজি ভাষায় সমস্তটা লিখিয়া দিয়াছিল যে, পোস্ট্‌আপিসের কোন্‌-এক বড়োবাবু স্বয়ং আসিয়া তদন্ত করিয়া