গোরা
বাড়িতেও এ বিয়ে হয় কি না সন্দেহ। বিনয়কেই সমস্ত বন্দোবস্ত করতে হবে। তাই আমি বলছিলুম, আমাদের বাড়ির উত্তর-ভাগটার একতলা তো ভাড়া দেওয়া হয়েছে— ওর দোতলার ভাড়াটেও উঠে গেছে, ঐ দোতলাতেই যদি বিনয়ের বিয়ের বন্দোবস্ত করা যায় তা হলে সুবিধা হয়।”

গোরা জিজ্ঞাসা করিল, “কী সুবিধা হয়?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “আমি না থাকলে ওর বিয়েতে দেখাশুনা করবে কে? ও যে মহা বিপদে পড়ে যাবে। ওখানে যদি বিয়ের ঠিক হয় তা হলে আমি এই বাড়ি থেকেই সমস্ত জোগাড়যন্ত্র করে দিতে পারি, কোনো হাঙ্গাম করতে হয় না।”

গোরা কহিল, “সে হবে না মা!”

আনন্দময়ী কহিলেন,“ কেন হবে না? কর্তাকে আমি রাজি করেছি।”

গোরা কহিল, “না মা, এ বিয়ে এখানে হতে পারবে না— আমি বলছি, আমার কথা শোনো।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “কেন, বিনয় তো ওদের মতে বিয়ে করছে না।”

গোরা কহিল, “ও-সমস্ত তর্কের কথা। সমাজের সঙ্গে ওকালতি চলবে না। বিনয় যা খুশি করুক, এ বিয়ে আমরা মানতে পারি নে। কলকাতা শহরে বাড়ির অভাব নেই। তার নিজেরই তো বাসা আছে।”

বাড়ি অনেক মেলে আনন্দময়ী তাহা জানিতেন। কিন্তু বিনয় যে আত্মীয়বন্ধু সকলের দ্বারা পরিত্যক্ত হইয়া নিতান্ত লক্ষ্মীছাড়ার মতো কোনো গতিকে বাসায় বসিয়া বিবাহ-কর্ম সারিয়া লইবে ইহা তাঁহার মনে বাজিতেছিল। সেইজন্য তিনি তাঁহাদের বাড়ির যে অংশ ভাড়া দিবার জন্য স্বতন্ত্র রহিয়াছে সেইখানে বিনয়ের বিবাহ দিবার কথা মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন। ইহাতে সমাজের সঙ্গে কোনো বিরোধ না বাধাইয়া তাঁহাদের আপন বাড়িতে শুভকর্মের অনুষ্ঠান করিয়া তিনি তৃপ্তিলাভ করিতে পারিতেন। গোরার দৃঢ় আপত্তি দেখিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “তোমাদের যদি এতে এতই অমত তা হলে অন্য জায়গাতেই বাড়ি ভাড়া করতে হবে। কিন্তু তাতে আমার উপরে ভারি টানাটানি পড়বে। তা হোক, যখন এটা হতেই পারবে না তখন এ নিয়ে আর ভেবে কী হবে!”

গোরা কহিল, “ মা, এ বিবাহে তুমি যোগ দিলে চলবে না।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “সে কী কথা গোরা, তুই বলিস কী! আমাদের বিনয়ের বিয়েতে আমি যোগ দেব না তো কে দেবে!”

গোরা কহিল, “সে কিছুতেই হবে না মা!”

আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরা, বিনয়ের সঙ্গে তোর মতের মিল না হতে পারে, তাই বলে কি তার সঙ্গে শত্রুতা করতে হবে?”

গোরা একটু উত্তেজিত হইয়া উঠিয়া কহিল, “মা, এ কথা তুমি অন্যায় বলছ। আজ বিনয়ের বিয়েতে আমি যে আমোদ করে যোগ দিতে পারছি নে এ কথা আমার পক্ষে সুখের কথা নয়। বিনয়কে আমি যে কতখানি ভালোবাসি সে আর কেউ না জানে তো তুমি জান। কিন্তু, মা, এ ভালোবাসার কথা নয়, এর মধ্যে শত্রুতা মিত্রতা কিছুমাত্র নেই। বিনয় এর ফলাফল সমস্ত জেনেশুনেই এ কাজে প্রবৃত্ত হয়েছে। আমরা তাকে পরিত্যাগ করি নি, সেই আমাদের পরিত্যাগ করেছে। সুতরাং এখন যে বিচ্ছেদ ঘটেছে সেজন্যে সে এমন কোনো আঘাত পাবে না যা তার প্রত্যাশার অতীত।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “গোরা, বিনয় জানে এই বিয়েতে তোমার সঙ্গে তার কোনোরকম যোগ থাকবে না, সে কথা ঠিক। কিন্তু এও সে নিশ্চয় জানে শুভকর্মে আমি তাকে কোনো মতেই পরিত্যাগ করতে পারব না। বিনয়ের বউকে আমি আশীর্বাদ করে গ্রহণ করব না এ কথা বিনয় যদি মনে করত তা হলে আমি বলছি সে প্রাণ গেলেও এ বিয়ে করতে পারত না। আমি কি বিনয়ের মন জানি নে!”