কালের যাত্রা
জলগ্রহণ করবে না। তোমার চেষ্টাতেও যদি রথ না চলে লজ্জা কিসের, স্বয়ং পুরোহিত রাজা সকলেরই চেষ্টা ব্যর্থ হল, দেশসুদ্ধ লোক তো তা দেখেছে।

ধনপতি। তাঁরা হলেন লোকপাল, আমরা হলুম পালের লোক ; জনসাধারণে তাঁদের বিচার করে একরকমে, আমাদের বিচার করে আর-এক রকমে। রথ যদি না চলে আমার লজ্জা আছে, কিন্তু রথ যদি চলে তা হলে আমার ভয়। তা হলে আমার সেই শুভাদৃষ্টের স্পর্ধা কোনো লোক ক্ষমা করতে পারবেই না। তখন কাল থেকে তোমারাই ভাবতে বসবে আমাকে খর্ব করা যায় কী উপায়ে।

মন্ত্রী। যা বলছ সবই সত্য হতে পারে, কিন্তু তবুও রথ চলা চাই। আর বেশিক্ষণ যদি দ্বিধা কর তা হলে দেশের লোক ক্ষেপে যাবে।

ধনপতি। আচ্ছা, তবে চেষ্টা করে দেখি। কিন্তু যদি দৈবক্রমে আমার চেষ্টা সফল হয় তা হলে আমার অপরাধ নিয়ো না। ( দলের লোকদের প্রতি) বলো সিদ্ধিরস্তু।

সকলে। সিদ্ধিরস্তু!

ধনপতি। বলো, জয় সিদ্ধিদেবী!

সকলে। জয় সিদ্ধিদেবী!

ধনপতি। টানব কী! এ রশি যে তুলতেই পারি নে। মহাকালের রথও যেমন ভারী, রশিও তেমনি, এ ভার বহন কি সহজ লোকের কর্ম। ( দলের লোকের প্রতি) এসো, তোমরাও সবাই এসো। সকলে মিলে হাত লাগাও। আমার খাতাঞ্চি কোথায় গেল। এসো, এসো। কোষাধ্যক্ষ! আবার বলো, সিদ্ধরস্তু — টানো। সিদ্ধিরস্তু, আর-এক টান! সিদ্ধিরস্তু — জোরে! নাঃ, কিছুই হল না। আমাদের হাতে রশিটা ক্রমেই যেন আড়ষ্ট হয়ে উঠছে।

সকলে। দুয়ো! দুয়ো!

১ সৈনিক। যাক। আমাদের মান রক্ষা হল।

ধনপতি। নমস্কার, মহাকাল! তুমি আমার সহায়, তাই তুমি স্থির হয়ে রইলে। আমার হাতে যদি তুমি টলতে, আমারই ঘাড়ের উপরে টলে পড়তে, একেবারে পিষে যেতুম।

খাতাঞ্চি। প্রভু, এই যুগে আমাদের যে সম্মান সমাদর ক্রমেই বেড়ে উঠছিল সেটার বড়ো ক্ষতি হল।

ধনপতি। দেখো, এতকাল আমরা মহাকালের রথের ছায়ায় দাঁড়িয়ে লোকচক্ষুর অগোচরে বড়ো হয়েছি। আজ রথের সামনে এসে পড়ে আমাদের সংকট ঘটেছে — আশেপাশে লোকের দাঁত-কিড়মিড় অনেক দিন থেকে শুনছি। এখন যদি স্পষ্ট সবাই দেখতে পায় যে, রশি ধরে আমরাই রথ চালাচ্ছি তা হলে আমাদের উপর এমন দৃষ্টি লাগবে যে বেশিক্ষণ টিকব না।

১ সৈনিক। যদি সেকাল থাকত তা হলে তোমার হাতে রথ চলল না বলে তোমার মাথা কাটা যেত।

ধনপতি। অর্থাৎ, তোমরা তা হলে হাতে কাজ পেতে। মাথা কাটতে না পেলেই তোমরা বেকার।

১ সৈনিক। আজ কেউ তোমাদের গায়ে হাত দিতে সাহস করে না ; রাজাও না। এতে বাবা মহাকালেরই মান খর্ব হয়ে গেছে।

ধনপতি। সত্যি কথা বলি — যখন সবাই গায়ে হাত দিতে সাহস করত তখন ঢের বেশি নিরাপদে ছিলুম। আজ সবাই যে আমাদের মানতে বাধ্য হয়েছে এরই মধ্যে আমাদের মরণ। মন্ত্রীমশায়, চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবছ কী।

মন্ত্রী। ভাবছি সব-রকম চেষ্টাই ব্যর্থ হল, এখন কোনো উপায় তো আর বাকি নেই।