মালঞ্চ
সরলার হাত ধরে বিছানায় বসালে। বালিশের নীচে থেকে গহনার কেস টেনে নিয়ে একটি মুক্তোর মালা বের করে সরলাকে পরিয়ে দিলে।

একদিন ইচ্ছে করেছিলুম, যখন চিতায় আমার দাহ হবে এই মালাটি যেন আমার গলায় থাকে। কিন্তু তার চেয়ে এই ভালো। আমার হয়ে মালা তুমি গলায় পরে থাকো, শেষদিন পর্যন্ত। বিশেষ বিশেষ দিনে এ মালা কতকাল পরেছি সে তোমার দাদা জানেন। তোমার গলায় থাকলে সেই দিনগুলি ওঁর মনে পড়বে।

সরলা। অযোগ্য আমি দিদি, অযোগ্য। কেন আমাকে লজ্জা দিচ্ছ?

আদিত্য। ঐ মালাটা আমাকে দাও-না সরলা। ওর মূল্য আমার কাছে যতখানি এমন আর কারও কাছে নয়। ও আমি আর কাউকে দিতে পারব না।

নীরজা। আমার কপাল! এত করেও বোঝাতে পারলুম না বুঝি। সরলা, শুনেছিলেম এই বাগান থেকে তোমার চলে যাবার কথা হয়েছিল। সে আমি কোনোমতেই ঘটতে দেব না। তোমাকে আমি আমার সংসারের যা-কিছু, সমস্তর সঙ্গে রাখব বেঁধে, এই হারটি তারই চিহ্ন। এই আমার বাঁধন তোমার হাতে দিয়েছিলুম যাতে নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পারি।

সরলা। ভুল করছ দিদি, আমাকে বাঁধতে চেয়ো না। ভালো হবে না তাতে।

নীরজা। সে কী কথা?

সরলা। আমি সত্যি কথাই বলব। এতদিন আমাকে বিশ্বাস করতে পারতে। কিন্তু আজ আমাকে বিশ্বাস করো না, এই আমি তোমাদের সকলের সামনে বলছি। ভাগ্য যার থেকে আমাকে বঞ্চনা করেছে, কাউকে বঞ্চনা করে সে আমি নেব না। এই রইল তোমার পায়ে আমার প্রণাম। আমি চললেম। অপরাধ আমার নয়, অপরাধ সেই আমার ঠাকুরের যাঁকে সরল বিশ্বাসে রোজ দুবেলা পুজো করেছি। সেও আজ আমার শেষ হল।

এই বলে সরলা দ্রুতপদে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আদিত্য নিজেকে ধরে রাখতে পারলে না। সেও গেল চলে।

নীরজা। ঠাকুরপো, এ কী হল ঠাকুরপো। বলো ঠাকুরপো, একটা কথা কও।

রমেন। এইজন্যেই বলেছিলেম আজ রাত্রে ডেকো না।

নীরজা। কেন, মন খুলে আমি তো সবই দিয়ে দিয়েছি। ও কি তাও বুঝল না?

রমেন। বুঝেছে বৈকি। বুঝেছে যে মন তোমার খোলে নি। সুর বাজল না।

নীরজা। কিছুতে বিশুদ্ধ হল না আমার মন। এত মার খেয়েও। কে বিশুদ্ধ করে দেবে? ওগো সন্ন্যাসী, আমাকে বাঁচাও-না। ঠাকুরপো, কে আমার আছে, কার কাছে যাব আমি?

রমেন। আমি আছি বউদি। তোমার দায় আমি নেব। তুমি এখন ঘুমোও।

নীরজা। ঘুমোব কেমন করে? এ বাড়ি থেকে আবার যদি উনি চলে যান তা হলে মরণ নইলে আমার ঘুম হবে না।

রমেন। চলে উনি যেতে পারবেন না, সে ওঁর ইচ্ছায় নেই,শক্তিতে নেই। এই নাও ঘুমের ওষুধ, তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে তবে আমি যাব।

নীরজা। যাও ঠাকুরপো, তুমি যাও, ওরা দুজনে কোথায় গেল দেখে এসো, নইলে আমি নিজেই যাব, তাতে আমার শরীর ভাঙে ভাঙুক।

রমেন। আচ্ছা, আচ্ছা, আমি যাচ্ছি।

[রমেনের প্রস্থান