পরিশিষ্ট
কাব্য

আজকাল যাঁহারা সমালোচনা করিতে বসেন তাঁহারা কাব্য হইতে একটা-কিছু নূতন কথা বাহির করিতে চেষ্টা করেন। কবির ভাবের সহিত আপনার মনকে মিশাইবার চেষ্টা না করিয়া কোমর বাঁধিয়া খানাতল্লাশি করিতে উদ্যত হন। অনেক বাজে জিনিস হাতে ঠেকে, কিন্তু অনেক সময়েই আসল জিনিসটা পাওয়া যায় না।
কিন্তু তর্কই তাই, কে কোন্‌টাকে আসল জিনিস মনে করিতে পারে। একটা প্রস্তর-মূর্তির মধ্যে কেহ বা প্রস্তরটাকে আসল জিনিস মনে করিতে পারে, কেহ বা মূর্তিটাকে। সে স্থলে মীমাংসা করিতে হইলে বলিতে হয়, প্রস্তর তুমি নানা স্থান হইতে সংগ্রহ করিতে পারো, তাহার জন্য মূর্তি ভাঙিবার আবশ্যক নাই; কিন্তু এ মূর্তি আর কোথাও মিলিবে না। তেমনি কবিতা হইতে তত্ত্ব বাহির না করিয়া যাহারা সন্তুষ্ট না হয় তাহাদিগকে বলা যাইতে পারে, তত্ত্ব তুমি দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস প্রভৃতি নানা স্থান হইতে সংগ্রহ করিতে পারো, কিন্তু কাব্যরসই কবিতার বিশেষত্ব।

এই কাব্যরস কী তাহা বলা শক্ত। কারণ, তাহা তত্ত্বের ন্যায় প্রমাণযোগ্য নহে, অনুভবযোগ্য। যাহা প্রমাণ করা যায় তাহা প্রতিপন্ন করা সহজ; কিন্তু যাহা অনুভব করা যায় তাহা অনুভূত করাইবার সহজ পথ নাই, কেবলমাত্র ভাষার সাহায্যে একটা সংবাদ জ্ঞাপন করা যায় মাত্র। কেবল যদি বলা যায় ‘সুখ হইল’ তবে একটা খবর দেওয়া হয়, সুখ দেওয়া হয় না।

যে-সকল কথা সর্বাপেক্ষা প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করে অথচ যাহা সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সর্বাপেক্ষা শক্ত তাহা লইয়াই মানবের প্রধান ব্যাকুলতা। এই ব্যাকুলতা পিঞ্জররুদ্ধ বিহঙ্গের ন্যায় যেন সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে চঞ্চলভাবে পক্ষ আন্দোলন করিতেছে। তত্ত্বপ্রচার করিয়া মানবের সম্পূর্ণ পরিতৃপ্তি নাই, আত্মপ্রকাশ করিবার জন্য তাহার হৃদয় সর্বদা ব্যগ্র হইয়া আছে। কাব্যের মধ্যে মানবের সেই আত্মপ্রকাশের চেষ্টা কথঞ্চিৎ সফলতা লাভ করে; কাব্যের মর্যাদাই তাই। একটি ক্ষুদ্র প্রেমের কবিতার মধ্যে কোনো তত্ত্বই নাই, কিন্তু চিরকালীন মানবপ্রকৃতির আত্মপ্রকাশ রহিয়া গেছে। এইজন্য মানব চিরকালই তাহার সমাদর করিবে। ছবি-গান-কাব্যে মানব ক্রমাগতই আপনার সেই চিরান্ধকারশায়ী আপনাকে গোপনতা হইতে উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিতেছে। এইজন্যই একটা ভালো ছবি, ভালো গান, ভালো কাব্য পাইলে আমরা বাঁচিয়া যাই।

আত্মপ্রকাশের অর্থই এই, আমার কোন্‌টা কেমন লাগে তাহা প্রকাশ করা। কোন্‌টা কী তাহার দ্বারা বাহিরের বস্তু নিরূপিত হয়, আমার কোন্‌টা কেমন লাগে তাহার দ্বারা আমি নির্দিষ্ট হই। নক্ষত্র যে অগ্নিময় জ্যোতিষ্ক তাহা নক্ষত্রের বিশেষত্ব, কিন্ত নক্ষত্র যে রহস্যময় সুন্দর তাহা আমার আত্মার বিশেষত্ব-বশত। যখন আমি নক্ষত্রকে জ্যোতিষ্ক বলিয়া জানি তখন নক্ষত্রকেই জানি, কিন্তু যখন আমি নক্ষত্রকে সুন্দর বলিয়া জানি তখন নক্ষত্রলোকের মধ্যে আমার আপনার হৃদয়কেই অনুভব করি।

এইরূপে কাব্যে আমরা আমাদের বিকাশ উপলব্ধি করি। তাহার সহিত নূতন তত্ত্বের কোনো যোগ নাই। বাল্মীকি যাহা ব্যক্ত করিয়াছেন তাহা বাল্মীকির সময়েও একান্ত পুরাতন ছিল। রামের গুণ বর্ণনা করিয়া তিনি বলিয়াছেন ভালো লোককে আমরা ভালোবাসি। কেবলমাত্র এই মান্ধাতার আমলের তত্ত্ব প্রচার করিবার জন্য সাতকাণ্ড রামায়ণ লিখিবার কোনো আবশ্যক ছিল না। কিন্তু ভালো যে কত ভালো, অর্থাৎ ভালোকে যে কত ভালো লাগে তাহা সাত-কাণ্ড রামায়ণেই প্রকাশ করা যায়; দর্শনে বিজ্ঞানে কিম্বা সুচতুর সমালোচনায় প্রকাশ করা যায় না।

হে বিষয়ী, হে সুবুদ্ধি, ক্ষুদ্র প্রেমের কবিতা দেখিয়া তুমি যে বিজ্ঞভাবে অবজ্ঞা প্রকাশ করিতেছ, বলিতেছ ‘উহার মধ্যে নূতন