গ্রন্থসমালোচনা

রাবণ-বধ দৃশ্য কাব্য। শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রণীত। মূল্য ১ টাকা।

অভিমন্যু-বধ দৃশ্য কাব্য। শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রণীত। মূল্য ১ টাকা।

সে দিন আমরা একখানি বাংলা কবিতা গ্রন্থে দেখিতেছিলাম সীতা দেবীকে বনবাস দিয়া লক্ষ্মণ যখন চলিয়া আসিতেছেন, তখন সীতা দেবী সকাতরে তাঁহাকে একটু দাঁড়াইবার জন্য এই বলিয়া মিনতি করিতেছেন-

“লক্ষ্মণ দেবর কেন ধাওয়া-ধাওয়ি যাও রে।
তোমার দাদার কিরে বারেক দাঁড়াও রে”

এমন-কি, মাইকেলও তাঁহার মেঘনাদবধ কাব্যে শূর-শ্রেষ্ঠ লক্ষ্মণ দেবরকে কী বেরঙে আঁকিয়াছেন।–ইহা কি সামান্য পরিতাপের বিষয় যে, যে লক্ষ্মণকে আমরা রামায়ণে শৌর্যের আদর্শ স্বরূপ মনে করিয়াছিলাম–যে লক্ষ্মণকে আমরা কেবলমাত্র মূর্তিমান ভ্রাতৃস্নেহ ও নিঃস্বার্থ উদারতা ও বিক্রম বলিয়া ভাবিয়া আসিতেছি, সেই লক্ষ্মণকে মেঘনাদ কাব্যে একজন ভীরু স্বার্থপূর্ণ–”গোঁয়ার” মাত্র দেখিলে আমাদের বুকে কী আঘাতই লাগে! কেনই বা তা হইবে না? কল্পনার আদর্শভূত একটি পশুপক্ষীরও একগাছি লোমের হানি করিলেও আমাদের সহ্য হয় না। সুখের বিষয় এই যে শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র আমাদের প্রাণে সে আঘাত দেন নাই। কি তাঁহার অভিমন্যু-বধ, আর কি তাঁহার রাবণ-বধ–এই উভয় নাটকেই তিনি রামায়ণ ও মহাভারতের নায়ক ও উপনায়কদের চরিত্র অতি সুন্দর রূপে রক্ষা করিতে পারিয়াছেন। ইহা সামান্য সুখ্যাতির কথা নহে। এক খণ্ড কয়লার মধ্যে সূর্যের আলোক তো প্রবেশই করিতে পারে না, কিন্তু এক খণ্ড স্ফটিকে শুদ্ধ যে সূর্যকিরণ প্রবেশ করিতে পারে এমন নয়, আবার স্ফাটিক্য গুণে সেই কিরণ সহস্র বর্ণে প্রতিফলিত হইয়া সূর্যের মহিমা ও স্ফটিকের স্বচ্ছতা প্রচার করে। শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্রবাবুর কল্পনা সেই স্ফটিক-খণ্ড–এবং তাঁহার অভিমন্যুবধ ও রাবণ-বধ রামায়ণ ও মহাভারতের প্রতিফলিত রশ্মিপুঞ্জ। অভিমন্যুর নাম উচ্চারণ হইলেই আমাদের মনে যে ভাব উদয় হয় অভিমন্যু-বধ কাব্য পড়িয়া সে ভাবের কিছুমাত্র বৈলক্ষণ্য হয় না, বরং সে ভাব আরও উজ্জ্বলতর রূপে ফুটিয়া উঠে। যে অভিমন্যু বিশ্ববিজয়ী অর্জুন ও বীরাঙ্গনা সুভদ্রার সন্তান, তাহার তেজস্বিতা তো থাকিবেই, অথচ অভিমন্যুর কথা মনে আসিলেই সূর্যের কথা মনে আসে না,কারণ সূর্য বলিতেই কেবল প্রখর তীব্র তেজোরাশির সমষ্টি বুঝায়–কিন্তু অভিমন্যুর সঙ্গে কেমন একটি সুকুমার সুন্দর যুবার ভাব ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযোজিত আছে যে, তাহার জন্য অভিমন্যুকে মনে পড়িলেই চন্দ্রের কথা মনে হওয়া উচিত, কিন্তু তাহাও হইতে পারে না, কারণ চন্দ্রের তেজস্বিতা তো কিছুই নাই। সেইজন্য অভিমন্যুকে আমরা চন্দ্র-সূর্য-মিশ্রিত একটি অপরূপ সামগ্রী বলিয়াই মনে করি। অভিমন্যু-বধের অভিমন্যু, আমাদের সেই মহাভারতের অভিমন্যু সেই আমাদের অভিমন্যু-কল্পনার আদর্শভূত অভিমন্যু। এই বঙ্গীয় নাটকখানিতে যেখানেই আমরা অভিমন্যুকে পাইয়াছি–কি উত্তরার সঙ্গে প্রেমালাপে, কি সুভদ্রার সঙ্গে স্নেহ-বিনিময়ে, কি সপ্তরথীর দুর্ভেদ্য ব্যূহমধ্যে বীরকার্য সাধনে–সকল স্থানেই এই নাটকের অভিমন্যু প্রকৃত অভিমন্যুই হইয়াছে। বলিতে কি, মহাভারতের সকল ব্যক্তিগুলিই শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্রের হস্তে কষ্টকর মৃত্যুতে, জীবন না ফুরাইলেও অপঘাত মৃত্যুতে প্রাণ ত্যাগ করে নাই। ব্যাসদেবের কথা অনুসারে, যাহার যখন মৃত্যু আবশ্যক, গিরীশবাবু তাহাই করিয়াছেন। মাইকেল মহাশয় যেমন অকারণে লক্ষ্মণকে অসময়ে মেঘনাদের সঙ্গে যুদ্ধে মারিয়াছেন অর্থাৎ প্রকৃত প্রস্তাবে লক্ষণের ধ্বংস সাধন করিয়াছেন গিরিশবাবু অভিমন্যুকে কি অর্জুনকে কি কৃষ্ণকে কোথাও সেরূপ হত্যা করেন নাই–ইহা তাঁহার বিশেষ গৌরব। তাঁহার আরও গৌরবের কথা বলিতে বাকি আছে। তাঁহার কল্পনার পরিচয় দিতে আমরা অত্যন্ত আনন্দ লাভ করিতেছি। স্বপ্নদেবীর সঙ্গে রজনীর যে