প্রকল্প সম্বন্ধেপ্রকল্প রূপায়ণেরবীন্দ্র-রচনাবলীজ্ঞাতব্য বিষয়পাঠকের চোখেআমাদের লিখুনডাউনলোডঅন্যান্য রচনা-সম্ভার |
মা। মাঠপারের রাস্তা দিয়ে ঐ-যে কারা চলেছে, প্রকৃতি, পীতবসন-পরা।
প্রকৃতি। তাই তো, ও যে দেখছি সংঘের সব শ্রমণ। শুনছ না, পড়ছেন মন্ত্র?
পথে শ্রমণেরা। বুদ্ধো সুসুদ্ধো করুণামহাণ্নবো
যোচ্চন্ত সুদ্ধব্বর-ঞানলোচনো।
লোকস্স পাপূপকিলেসঘাতকো
বন্দামি বুদ্ধম্ অহমাদরেণ তম্।
প্রকৃতি। মা, ঐ-যে তিনি চলেছেন সবার আগে আগে। এই কুয়োতলার দিকে ফিরে তাকালেন না। আর-একবার তো বলে যেতে পারতেন, জল দাও। মনে হয়েছিল, আমাকে উনি ফেলে যেতে পারবেন না, আমি যে ওঁর নিজের হাতের নতুন সৃষ্টি। (বসে প’ড়ে বার বার মাটিতে মাথা ঠুকে) এই মাটি, এই মাটি, এই মাটিই তোর আপন—হতভাগিনী, কে তোকে আলোতে ফুটিয়ে তুলেছিল এক মুহূর্তের জন্যে। তাকে কি দয়া বলে। শেষে পড়তে হল এই মাটিতেই— চিরদিন মিশিয়ে থাকতে হবে এই মাটিতেই, যত লোক চলে রাস্তায় তাদের পায়ের তলায়।
মা। বাছা, ভুলে যা, ভুলে যা এ সমস্ত-কিছু। তোর এক নিমেষের স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে ওরা যাচ্ছে চলে, যাক যাক। যা টেঁকবার নয় তা যত শীঘ্র যায় ততই ভালো।
প্রকৃতি। এই প্রতিদিনের চাই চাই চাই, এই প্রতি মুহূর্তের অপমান, বুকের ভিতরে এই খাঁচার পাখির পাখা-আছড়ে-মরা, একেই বলে স্বপ্ন? যা বুকের সব শিরা কামড়ে ধরে থাকে, ছাড়তে চায় না, তাই স্বপ্ন? আর ঐ ওরা, নেই কোনো বাঁধন, নেই কোনো সুখদুঃখ, নেই কোনো সংসারের বোঝা— ভেসে চলে যায় শরৎকালের মেঘের মতো— ওরাই আছে জেগে, ওরাই স্বপ্ন নয়?
মা। তোর কষ্ট দেখতে পারি নে, প্রকৃতি। ওঠ্ তুই। আনবই তাঁকে মন্ত্র পড়ে। নিয়ে আসব ধুলোর পথ দিয়েই। ‘কিছু চাই না’ বলার অহংকার ভাঙব তাঁর— ‘চাই চাই’ বলেই আসতে হবে তাঁকে ছুটে।
প্রকৃতি। মা, তোমার মন্ত্র জীবসৃষ্টির আদিকালের। এদের মন্ত্র কাঁচা, এই সেদিনকার। ওরা পারবে না তোমার সঙ্গে। তোমার মন্ত্রের টানে খুলবে ওদের মন্ত্রের গাঁঠ। ওঁকে হারতেই হবে, হারতেই হবে।
মা। কোথায় যাচ্ছে ওরা।
প্রকৃতি। ওরা যায় এইমাত্র জানি, ওরা কোনোখানেই যায় না। বর্ষা আসবে কিছুদিন পরে, তখন বসবে চাতুর্মাস্যে। আবার যাবে, কী জানি কোথায়। একেই ওরা বলে জেগে থাকা!
মা। পাগলি, তবে কী বলছিস মন্তরের কথা। চলে যাচ্ছে কত দূরে— কোথা থেকে আনব ফিরিয়ে।
প্রকৃতি। যেখানেই যাক ফেরাতেই হবে, দূর নেই তোর মন্তরের কাছে।
যায় যদি যাক সাগরতীরে।