শোধবোধ
বিধবা জায়ের প্রবেশ

জা। ভাই, তোমরা এখানে ভালো হয়ে বসেই কথা কও-না। দাঁড়িয়ে কেন। আমি পাশের ঘরে আছি বলে বুঝি আলাপ জমছে না? ভয় নেই ভাই, আমি নীচের ঘরে যাচ্ছি।

[ প্রস্থান
সতীশের প্রবেশ ও বাপকে দেখিয়াই পলায়ন

মন্মথ। ও কী ও, তোমার ছেলেটিকে কী মাখিয়েছ।

বিধুমুখী। মূর্ছা যেয়ো না, ভয়ানক কিছু নয়, একটুখানি এসেন্স্‌ মাত্র। তাও বিলাতি নয় — তোমাদের সাধের দিশি।

মন্মথ। আমি তোমাকে বারবার বলেছি, ছেলেদের তুমি এ-সমস্ত শৌখিন জিনিস অভ্যাস করাতে পারবে না।

বিধুমুখী। আচ্ছা, যদি তোমার আরাম বোধ হয় তো কাল থেকে মাথায় কেরোসিন মাখাব, আর গায়ে কাস্টর-অয়েল।

মন্মথ। সেও বাজে খরচ হবে। কেরোসিন কাস্টর-অয়েল গায়-মাথায় মাখা আমার মতে অনাবশ্যক।

বিধুমুখী। তোমার মতে আবশ্যক জিনিস কটা আছে তা তো জানি না, গোড়াতেই আমাকে বোধ হয় বাদ দিয়ে বসতে হয়।

মন্মথ। তোমাকে বাদ দিলে যে বাদপ্রতিবাদ একেবারেই বন্ধ হবে। এতকালের দৈনিক অভ্যাস হঠাৎ ছাড়লে এ-বয়সে হয়তো সহ্য হবে না। যাই হোক, এ কথা আমি তোমাকে আগে থাকতে বলে রাখছি, ছেলেটিকে তুমি সাহেব কর বা নবাব কর, তার খরচ আমি জোগাব না। আমার মৃত্যুর পরে সে যা পাবে, তাতে তার শখের খরচ চলবে না।

বিধুমুখী। সে আমি জানি। তোমার টাকার উপরে ভরসা রাখলে ছেলেকে কপনি পরানো অভ্যাস করাতেম।

মন্মথ। আমিও তা জানি। তোমার ভগিনীপতি শশধরের ’পরেই তোমার ভরসা। তার সন্তান নেই বলে ঠিক করে বসে আছ, তোমার ছেলেকেই সে উইলে সমস্ত লিখে-পড়ে দিয়ে যাবে। সেইজন্যই যখন-তখন ছেলেটাকে ফিরিঙ্গি সাজিয়ে এক-গা গন্ধ মাখিয়ে তার মেসোর আদর কাড়বার জন্য পাঠিয়ে দাও! আমি দারিদ্র্যের লজ্জা অনায়াসেই সহ্য করতে পারি; কিন্তু ধনী কুটুম্বের সোহোগ-যাচনার লজ্জা আমার সহ্য হয় না।

বিধুমুখী। ছেলেকে মাসির কাছে পাঠালেও গায়ে সয় না, এতবড়ো মানী লোকের ঘরে আছি, সে তো পূর্বে বুঝতে পারি নি।

বিধবা জায়ের প্রবেশ

জা। ভাবলুম এতক্ষণে কথা ফুরিয়ে গেছে, এইবার ঘরে এসে পানগুলো সেজে রাখি। কিন্তু এখনো ফুরোল না। মেজোবউ, তোদের ধন্য। আজ সে তোর ন-বছর বয়স থেকে শুরু হয়েছে, তবু তোদের কথা যে আর ফুরোল না! রাত্রে কুলোয় না, শেষকালে দিনেও দুই জনে মিলে ফিস্‌ ফিস্‌। তোদের জিবের আগায় বিধাতা এত মধু দিনরাত্রি জোগান কোথা থেকে, আমি তাই ভাবি। রাগ কোরো না ঠাকুরপো, তোমাদের মধুরালাপে ব্যাঘাত করব না।

বিধুমুখী। না দিদি, আমাদের মধুরালাপ লোকালয় থেকে অনেক দূরে গিয়েই করতে হবে, নইলে সবাই দৃষ্টি দেবে। ওগো, এসো — ছাতে এসো, গোটাকতক কথা বলে রাখি। তুমি আবার নাকি হঠাৎ কাল লঙ্কাদ্বীপে যাচ্ছ — এখানকার হাওয়া তোমার সহ্য হচ্ছে না?

[ উভয়ের প্রস্থান
সতীশের প্রবেশ