ললাটের লিখন
(বাঁশরী)

ছেলেবেলায় পৃথ্বীশের ডান দিকের কপালে চোট লেগেছিল ভুরুর মাঝখান থেকে উপর পর্যন্ত। সেই আঘাতে ডান চোখটাও সংকুচিত। পৃথ্বীশকে ভালো দেখতে কি না সেই প্রশ্নের উত্তরটা কাটা দাগের অবিচারে সম্পূর্ণ হতে পারল না। অদৃষ্টের এই লাঞ্ছনাকে এত দিন থেকে প্রকাশ্যে পৃথ্বীশ বহন করে আসছে তবুও দাগও যেমন মেলায় নি তেমনি ঘোচে নি তার সংকোচ। নতুন কারো সঙ্গে পরিচয় হবার উপলক্ষে প্রত্যেকবার ধিক্‌কারটা জেগে ওঠে মনে। কিন্তু বিধাতাকে গাল দেবার অধিকার তার নেই। তার রচনার ঐশ্বর্যকে বন্ধুরা স্বীকার করছে প্রচুর প্রশংসায়, শত্রুরা নিন্দাবাক্যের নিরন্তর কটুক্তিতে। লেখার চারি দিকে ভিড় জমছে। দু টাকা আড়াই টাকা দামের বইগুলো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে-ঘরে। সম্পাদকরা তার কলমের প্রসাদ ছুটোছাঁটা যা-ই পায় কিছুই ছাড়ে না। পাঠিকারা বলে, পৃথ্বীশবাবু মেয়েদের মন ও চরিত্র যেমন আশ্চর্য বোঝেন ও বর্ণনা করেন এমন সাধ্য নেই আর কোনো লেখকের। পুরুষ-বন্ধুরা বলে, ওর লেখায় মেয়েদের এত-যে স্তুতিবাদ সে কেবল হতভাগার ভাঙা কপালের দোষে। মুখশ্রী যদি অক্ষুণ্ন হত তা হলে মেয়েদের সম্বন্ধে সত্য কথা বাধত না মুখে। মুখের চেহারা বিপক্ষতা করায় মুখের অত্যুক্তিকে সহায় করেছে মনোহরণের অধ্যবসায়।

শ্রীমতী বাঁশরি সরকার ব্যারিস্টারি চক্রের মেয়ে — বাপ ব্যারিস্টার, ভাইরা ব্যারিস্টার। দু বার গেছে য়ুরোপে ছুটি উপলক্ষে। সাজে সজ্জায় ভাষায় ভঙ্গিতে আছে আধুনিক যুগের সুনিপুণ উদ্দামতা। রূপসী বলতে যা বোঝায় তা নয়, কিন্তু আকৃতিটা যেন ফ্রেঞ্চ পালিশ দিয়ে ঝকঝকে করা।

পৃথ্বীশকে বাঁশরি ঘিরে নিয়েছিল আপন দলের মধ্যে। পরিচয়ের আরম্ভকালে মানুষের বাক্যালংকারের সীমা যখন অনির্দিষ্ট থাকে সেইরকম একদা পৃথ্বীশ ওকে বলেছিল, পুরুষের প্রতিভা যদি হয় গাছের ফুল, মেয়েদের প্রভাব আকাশের আলো। কম পড়লে ফুলের রঙ খেলে না। সাহিত্যের ইতিহাস থেকে প্রমাণ অনেক সংগ্রহ করছে। সংগ্রহ করবার প্রেরণা আপন অন্তরের বেদনায়। তার প্রতিভা শতদলের উপর কোনো-না কোনো বীণাপাণিকে সে অনেকবার মনে মনে আসন দিতে চেয়েছে, বীণা না থাকলেও চলে যদি বিলিত জ্যাজনাচের ব্যাঞ্জোও থাকে তার হাতে। ওর যে বাক্‌লীলা মাঝে মাঝে অবসন্ন হয়ে পড়ে তাকে আন্দোলিত করবার প্রবাহ সে চায় কোনো মধুর রসের উৎ স থেকে। খুঁজে খুঁজে বেড়ায়, কখনো মনে করে এ, কখনো মনে করে সে।

একটা গল্প লিখেছিল জয়দেবের নামটা নিয়ে তাকে বদনাম দিয়ে। যে কাহিনী গেঁথেছিল তার জন্যে পুরাবৃত্তের কাছে লেখক ঋণী নয়। তাতে আছে কবি জয়দেব শাক্ত ; আর কাঞ্চনপ্রস্থের রাজমহিষী পদ্মাবতী বৈষ্ণব। মহিষীর হুকুমে কবি গান করতেন রাধাকৃষ্ণের লীলা নিয়ে। মহিষী শুনতেন পর্দার আড়ালে। সেই অন্তরালবর্তিনী কল্পমূর্তি জয়দেবের মনকে নিয়ে গিয়েছিল বৃন্দাবনের কুঞ্জছায়ায়। শক্তির মন্ত্র যিনি পেয়েছিলেন গুরুর কাছে তাঁর মনের রসের মন্ত্র ভেসে এল কেশধূপসুগন্ধীবেণীচুম্বিত বসন্ত-বাতাসে। লেখক জয়দেবের স্ত্রী মন্দাকিনীকে বানিয়েছিল মোটা মালমসলার ধুলোকাদা মাখা হাতে। এই অংশে লেখকের অনৈতিহাসিক নিঃসংকোচ প্রগল্‌ভতার প্রশংসা করেছে একদল। মাটি খোঁড়ার কোদালকে সে খনিত্র নামে শুদ্ধি করে নেয় নি বলে ভক্তেরা তাকে খেতাব দিয়েছে নব্যসাহিত্যের পূর্ণচন্দ্র অর্থাৎ কলঙ্কগর্বিত। ছাপা হবার পূর্বেই বাঁশরি গল্পটা শুনেছে আপন চায়ের টেবিলে, নিভৃতে। অন্য নিমন্ত্রিতেরা উঠে গিয়েছিল, ওদের সেই আলাপের আদি পর্বে যশস্বী লেখককে তৃপ্ত করবার জন্যে চাটুবাক্যের অমিতব্যায়কে