ললাটের লিখন

“ সুষমার মতো মেয়ের সুখী হবার জন্যে ভালোবাসার দরকার নেই। ”

“ কিসের দরকার আছে, টাকার?”

“ এটা তোমার যোগ্য কথা হল না বাঁশরি — এটা যদি বলত কলুটোলার ঘোষগিন্নি আশ্চর্য হতুম না। ”

“ আচ্ছা, ভুল করেছি। কিন্তু প্রশ্নটার উত্তর বাকি আছে। কিসের দরকার আছে সুষমার। ”

“ জীবনে ও একটা কোন্‌ লক্ষ্য ধরেছে, সেইটে ওর ধর্ম। সাধ্যমতো আমি যদি কিছু পরিমাণে তাকে সার্থক করতে পারি তা হলেই হল। ”

“ লক্ষ্যটা কী বোধহয় জান না। ”

“ জানবার চেষ্টাও করি নি। যদি আপনা হতে ইচ্ছে করে বলে জানতে পাব। ”

“ অর্থাৎ ওর লক্ষ্য তুমি নও, তোমার লক্ষ্য ওই মেয়ে। ”

“ তাই বলতে পারি। ”

“ এ তো পুরুষের মতো শোনাচ্ছে না, ক্ষত্রিয়ের মতো নয়ই। ”

“ আমার পৌরুষ দিয়ে ওর জীবন সম্পূর্ণ করব, ওর ব্রত সার্থক করব — আর কিছু চাই নে আমি। আমার শক্তিকে ওর প্রয়োজন আছে এই জেনে আমি খুশি। সেই কারণে সকলের মধ্যে আমাকেই ও বেছে নিয়েছে এই আমার গৌরব। ”

“ এতবড়ো পুরুষকে মন্ত্র পড়িয়েছে সন্ন্যাসী। বুদ্ধিকে ঘোলা করেছে, দৃষ্টিকে দিয়েছে চাপা। শুনলুম ভালো হল আমার, শ্রদ্ধা গেল ভেঙে ; বন্ধন গেল ছিঁড়ে। শিশুকে মানুষ করার কাজ আমার নয়, সে কাজের ভার সম্পুর্ণ দিলুম এই মেয়েকে। ”

এমন সময় ঘরে প্রবেশ করল মুক্তারাম। পদধূলি নিয়ে তাকে প্রণাম করলে সোমশংকর।

অগ্নিশিখার মতো বাঁশরি দাঁড়াল তার সামনে। বললে, “ আজ রাগ করবেন না। ধৈর্য ধরবেন, কিছু বলব, কিছু প্রশ্ন করব। ”

“ আচ্ছা বলো তুমি। ” – মুক্তারামের ইঙ্গিতে সোমশংকর চলে গেল।

“ জিজ্ঞাসা করি, সোমশংকরকে শ্রদ্ধা করেন আপনি। ”

“ বিশেষ শ্রদ্ধা করি। ”

“ তবে কেন এমন মেয়ের ভার দিচ্ছেন ওর কাঁধে যে ওকে ভালোবাসে না। ”

“ যে ভার দিয়েছি আমি তাকেই বলি মহদ্‌ভাব। বলি পুরস্কার। একমাত্র সোমশংকর সুষমাকে গ্রহণ করবার যোগ্য। ”

“ ওর চিরজীবনের সুখ নষ্ট করতে চান আপনি? ”

“ সুখকে উপেক্ষা করতে পারে ওই বীর মনের আনন্দে। ”

“ আপনি মানবপ্রকৃতিকে মানেন না? ”

“ নবপ্রকৃতিকেই মানি, তার চেয়ে নীচের প্রকৃতিকে নয়। ”

“ এতই যদি হল — বিবাহ ওরা নাই করত। ”

“ তের সঙ্গে ব্রতকে প্রাণের বন্ধনে যুক্ত করতে চেয়েছিলুম। খুঁজেছিলুম তেমন দুটি মানুষকে, দৈবাৎ পেয়েছি। এটা একটা সৃষ্টি হল। ”

আর কেউ হলে বাঁশরি জিজ্ঞাসা করত — ‘আপনি নিজেই করলেন না কেন? ' কিন্তু মুক্তারামের চোখের সামনে এ প্রশ্ন বেধে গেল।